Provat Bangla

গ্রাম-উপজেলায় যেভাবে বিএনপি নেতা-কর্মীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে

সারাদেশে পালিয়ে বেড়ানো বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ও উদ্বেগ কাজ করছে আক্রান্ত পরিবারগুলোর মধ্যে।

অথচ গত একমাসে সংঘটিত এসব হামলার ঘটনায় কোনো বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত, মামলা কিংবা কাউকে আটক করা যায়নি। রাতের আধাঁরে মুখোশ কিংবা হেলমেট পরে এসব হামলার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে পারছে না পুলিশ।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বেশ কিছু বাড়িতে হামলার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিবিসি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আক্রান্ত বাড়ির বিএনপি নেতা-কর্মীরা সবাই হয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নয়তো কারাগারে রয়েছে।

এসব এলাকায় রাতে দলবেধে ককটেল হামলা ও ভাঙচুর চালানোর কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।

ঘটনাস্থল সীতাকুণ্ড

সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের যুবদল সভাপতি মো. আলমগীরের বাড়িতে হামলা হয়েছে গত ১৯শে নভেম্বর। বাড়িতে তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, গভীর রাতে মুখোশধারী লোকজন তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে।

সাগরে দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় বিপদগ্রস্ত নৌযান তাদের অবস্থান জানান দিতে যে রকেট ফ্লেয়ার ব্যবহার করে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে মি. আলমগীরের বাড়িতে। এসব রকেট ফ্লেয়ার বিকট শব্দ করে এবং ধোয়া ছড়াতে সক্ষম বলে জানা যায়।

মরিয়ম বেগম বলছেন, ইট নিক্ষেপ এবং রকেট ফ্লেয়ার বিস্ফোরণে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার বাড়িতে।

“রাত তিনটায় বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি একের পর এক ককটেল, ইটের টুকরা এসে এসে ব্যালকনিতে পড়তেছে। আমার বেডরুমের জানালা যেখানে ওইখানে আমার খাট। আমার জানালে ভেঙে খাটে এসে পড়তেছে,” বিবিসি বাংলাকে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিলেন মরিয়ম আক্তার।

হামলায় বাড়ির ছোট শিশু ও বৃদ্ধ শ্বশুর আহত হন বলে জানান মিস মরিয়ম। দোতলা পাকা বাড়ির ভেতরের মেঝে ও সিড়িতে এখনো পোড়া চিহ্ন দেখা গেছে।

হামলার পরে মরিয়ম নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির একটি ভিডিও ধারণ করেন মোবাইলে যেখানে হামলার প্রমাণ মেলে।

এছাড়া বাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া ইট পাটকেল ও রকেট ফ্লেয়ারের খোসা আর ভাঙা কাঁচের টুকরো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এই হামলার পর তারা থানায় মামলা বা কোনো অভিযোগ দায়ের করেননি।

“আমাদের সঙ্গে কারো কোনো শত্রুতা নেই। বিএনপি করে এটাই কি তার অপরাধ? পুলিশের তল্লাশির কারণে আমার স্বামী ঘরে থাকেনা। তো পুলিশ এগুলো দেখেনা?” প্রশ্ন তোলেন মরিয়ম বেগম।

যুবদল নেতা আলমগীরের ঘর ছাড়াও সীতাকুণ্ডে আরো বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আট থেকে দশটি হামলার অভিযোগ করছে স্থানীয় বিএনপি।

গত ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর হয়েছে। মি. চৌধুরীর মালিকানাধীন সোনালী সিএনজি স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুরের চিহ্ন এখনো রয়েছে।

গত আট নভেম্বর এ প্রতিষ্ঠানে ভোর রাতে মাইক্রোবাসে একদল মুখোশধারী ব্যক্তি হামলা চালায় বলে স্টেশনের কর্মীরা জানান। তবে এ ঘটনায় তারাও কোনো মামলা বা থানায় অভিযোগ করেননি।

সীতাকুণ্ড থানার নিকটবর্তী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সামশুল আলম আজাদের বাড়ীতে গিয়েও হামলার চিহ্ন দেখা গেছে।।

ভুক্তভোগীদের তথ্য অনুযায়ী সীতাকুণ্ডে এসব হামলা হয়েছে গভীর রাতে। মুখোশ পরিহিত লোকজন মাইক্রোবাসে এসে হামলায় অংশ নিয়েছে।

বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ী-ঘরএমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা হচ্ছে
ছবির ক্যাপশান,বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে।

নোয়াখালীতে অভিযোগ বেশি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের আক্রান্ত বাড়ি-ঘর ঘুরে দেখেছে বিবিসি। নোয়াখালী জেলায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাতেই সবচে বেশি সংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ করেছে বিএনপি।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, তিন দফা সংবাদ সম্মেলন করে তারা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তারপরেও হামলা থামেনি। কোনো প্রতিকারও নেই। মি. রহমান অভিযোগ করেন কোম্পানিগঞ্জ উপজেলাতেই ২৯জন নেতাকর্মীর বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে।

“হামলা বন্ধ হয় নাই। মনে হয় আরো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কী বলবো একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।”

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে যুবদল নেতা জাহিদুর রহমান রাজন অন্যতম।

গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপণে আছেন। তার এক ভাই বিদেশ থাকেন এবং আরেক ভাই বাংলাদেশ পুলিশের চাকরি করেন।

মি. রাজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় হামলায় ক্ষতিগস্ত হয়েছে বাড়ির কাঁচের জানালা ও বিদ্যুৎ বাতি। বাড়ির সীমানায় টিনের বেড়ায় রয়েছে আঘাতের চিহ্ন।

মি. রাজনের পরিবারের দাবি মধ্যরাতে মোটরসাইকেল নিয়ে অর্ধশতাধিক লোকজন এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। লাঠিসোটা ও ইট নিয়ে হামলা চালায়।

হামলার সময় বাড়ির লোকজনের ধারণ করা ভিডিওতে চিৎকার চেচামেচির মধ্যে শোনা যায় গালিগালাজ করে হামলাকারীরা রাজনকে তালাশ করছে।

রাজনের মা সেতারা বেগম জানান, হামলাকারীরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং গত একমাসে তিন দফায় তাদের বাড়িতে এসেছেন।

দলবেধে এসে ককটেল ফাটিয়ে একাধিকবার বাড়িতে হানা দেয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত এলাকার পাশাপাশি বাড়ির নারী ও শিশুরা।

“একটুও ঘুমাইতে ফাইরতেছি না। আতঙ্কের মইদ্যে আছি। আমার মনে হয় যে মির্জা মহোদয় (কাদের মির্জা) ওনাদেরকে কন্টোল কইরতে ফাইরতেছে না। নয় এবাবে ফইত্যেকদিন রাত্রে আসি এবাবে আক্রমণ করা বাড়ী বাড়ী। কোনোদিন রাইতে তিনটা বাজে আসে, কোনোদিন এগারোটা বাজে আসে, কোনোদিন দশটা বাজে আসে,” বলছিলেন এলাকার একজন নারী।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় হামলার শিকার চারটি বাড়িতে সরেজমিনে ঘুরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, সবগুলো হামলা একই কায়দায় হচ্ছে।

কোম্পানীগঞ্জে এসব হামলায় কোনো বাড়ির ভেতরে ঢোকার প্রমাণ দেখা যায়নি। তবে ভয়ভীতি প্রদর্শন একটা বড় উদ্দেশ্য বলেই ভুক্তভোগীদের কথায় উঠে এসেছে।

সুজনের এ বাড়ী একমাসে তিনবার হামলার শিকার বলে অভিযোগ করছে পরিবার
ছবির ক্যাপশান,এ বাড়িতে একমাসে তিনবার হামলার হয়েছে বলে অভিযোগ করছে পরিবার।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মামুদুর রহমান রিপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কেউ নেই।

মি. রিপনের বাড়িতে একাধিকবার লোকজন দলবল নিয়ে তাকে খোজাখুজি করেছে। বাড়ির প্রধান ফটকে হামলার চিহ্ন রয়েছে। প্রাচীরের ওপর বাতিটিও ভাঙা রয়েছে। প্রধান ফটকের দরজাটিও খুলে নিয়ে গেছে বলেও অভিযোগ করেন রিপন।

একই উপজেলা ছাত্রদল নেতা সাহেদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। সেখানে ঘরে জানালা আঘাত ও টিনের বেড়ায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সাহেদের পিতা জানান ককটেল ফাটিয়ে এ হামলা চালানো হয়েছে।

এসময় সাহেদকে খোঁজাখুজি করা হয়েছে। সাহেদের বাড়ির নিকটেই তার চাচাতো ভাই ব্যবসায়ী সুজনের বাড়িতেও তিনবার হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। সুজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় জানালা এখনো ভাঙা। প্রথমদিন হামলায় ভাঙা মোটরসাইকেলের খণ্ডাংশ পড়ে রয়েছে ঘরের আঙিনায়।

মি. সুজনের স্ত্রী জানান, ভয়ে তারা রাতে বাড়িতে থাকতে ভয় পান। তার শাশুড়ি মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন আর তিনি থাকছেন তার বাপের বাড়িতে।

“এক মাসে তিনবার আসছে। কারো হাতের রড থাকে, কারো হাতে পাইপ থাকে। সবাই মুখোশ পরে আসে,” বলছিলেন সুজনের স্ত্রী।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর তথ্য অনুযায়ী সব হামলাই হয়েছে রাতে। যারা হামলা অংশ নিয়েছে তারা দলবেধে মোটরসাইকেলে চড়ে এসেছে। ২৫-৩০টি মটরসাইকেল এই হামলায় অংশ নেয়। হামলাকারী প্রত্যেকেই হেলমেট অথবা মুখোশ পরা থাকে বলে পরিবারগুলো অভিযোগ করছে।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ হলো আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী এলাকা। তার ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং এলাকায় প্রভাবশালী নেতা।

কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলার অভিযোগগুলো বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি এগুলা ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল কাদের মির্জা
ছবির ক্যাপশান,উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল কাদের মির্জা

মি. মির্জা বলেন, “নিজেরা ভাঙচুর করে এগুলা আপনাদের দেখাইচ্ছে। কোনো বাড়িতে জানালা দরজা ভাঙে নাই। যদি ভাঙচুর হইতো তাৎক্ষণিক আমরা জাইনতে ফারতাম।”

ভুক্তভোগীরা এসব হামলায় আওয়ামী লীগের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে।

এই প্রশ্নে কাদের মির্জা বলেন, “প্রশ্নই উঠে না। তারা তো বাড়িতেই নাই। তাদের বাড়িতে এগুলা করার যুক্তিকতা আছে নাকি। প্রতিপক্ষ নাই, সেক্ষেত্রে আমরা এগুলা করার মানে মানুষের আরামের ঘুম হারাম করার কোনো যুক্তিকতা আছে? এগুলা মিথ্যাচার।”

পুলিশ যা বলছে

বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর কিংবা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনার বিষয়ে পুলিশের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে সীতাকুণ্ড ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসির সঙ্গে কথা হয় বিবিসির।

সীতাকুণ্ড থানার ওসি জানান, বাড়িঘরে হামলার বিষয়ে তার থানায় কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি। কোনো মামলাও হয়নি। তবে এসব ঘটনা সম্পর্কে ‘ছায়া তদন্ত’ হচ্ছে বলে সীতাকুণ্ড থানার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সীতাকুণ্ড থানা
ছবির ক্যাপশান,সীতাকুণ্ড থানা

অন্যদিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলার কোনো ঘটনা তদন্ত করেনি। কারা এসব করছে সেটিও জানেনা পুলিশ।

এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেভাবে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতে দেখা যায়, এসব হামলা নিয়ে পুলিশও এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি।

হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ প্রণব চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, তিনি এগুলো দেখেননি।

“এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো আছে। রাত্রে বেলা কিন্তু আমার তিনটা টহল পার্টি কাজ করে। এরকম যদি হেলমেট কোনো বাহিনী বা মোটরসাইকেল নিয়ে যদি কোনো বাহিনী আসা-যাওয়া করতো, অন্তত আমার অফিসারের চোখেতো পড়তো। এটার কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না,” বলেন ওসি প্রণব চৌধুরী।

বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের বাড়িঘরে হামলার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রমাণ দেখেছে – এমন প্রশ্নে মি. চৌধুরী বলেন, অভিযোগ না থাকায় পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেনা।

“আমার কাছে সিম্পলি একটা অভিযোগও যদি আসতো আমরা সেই অভিযোগটা নিয়ে এগোতে পারতাম। আমার থানার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। মৌখিক অভিযোগও করেনি। সেই মোতাবেক আমরা ব্যবস্থাও নিতে পারছি না,” বলেন ওসি প্রণব চৌধুরী।

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি

Related Posts